প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস
| ক্রমিক | বিবেচ্য বিষয় | বিস্তারিত তথ্য |
|---|---|---|
|
1
|
প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস
|
কওমী মহিলা মাদ্রাসার ইতিহাস বাংলা উপমহাদেশে ইসলামের আগমন শুধু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের পরিচয়ই দেয়নি; বরং জ্ঞান, শিক্ষা ও সভ্যতার এক উজ্জ্বল ধারা প্রতিষ্ঠা করেছে। মুসলিম সমাজের মানসিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে যুগে যুগে যে প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ ভূমিকা রেখেছে, কওমী মাদ্রাসা তার অন্যতম। আর এই ধারারই একটি অনন্য অধ্যায়— কওমী মহিলা মাদ্রাসার ইতিহাস; যা একদিকে নারীশিক্ষার নবদিগন্ত উন্মোচন করেছে, অন্যদিকে সমাজে ইসলামী মূল্যবোধের সুগভীর ভিত্তি স্থাপন করেছে। কওমী শিক্ষাব্যবস্থার সূচনা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে দারুল উলূম দিওবন্দের হাত ধরে। উপনিবেশিক শিক্ষার ঢেউ যখন মুসলিম সমাজের ধর্মীয় পরিচয়কে সংকটাপন্ন করে তুলেছিল, তখনই উলামায়ে হক্কানী দ্বীনের সংরক্ষণে স্বতন্ত্র ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ নেন। কিন্তু সে সময় সমাজের রক্ষণশীলতা ও নানা সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে নারীরা এই শিক্ষা ধারার সুবিধা থেকে প্রায় বঞ্চিত ছিলেন। বাড়ির আঙিনায় সীমিত পরিসরে কিছু নারীর শিক্ষালাভ হলেও সংগঠিত প্রতিষ্ঠান গঠনের চিন্তা তখনও বাস্তব রূপ পায়নি। বিশ শতকের সূচনালগ্নে যখন উলামায়ে কেরাম উপলব্ধি করলেন— “একটি জাতির প্রকৃত ইসলামী পুনর্জাগরণ নারীশিক্ষাকে বাদ দিয়ে কখনো পূর্ণতা পেতে পারে না,” তখনই শুরু হয় কওমী মহিলা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ভাবনা। প্রথমদিকে দিওবন্দ, সাহারানপুর, লখনৌসহ বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট মহিলা মাদ্রাসা গড়ে ওঠে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল নারীদের জন্য নিরাপদ, শালীন ও পূর্ণাঙ্গ দ্বীনি শিক্ষার নতুন দ্বার। ধীরে ধীরে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ শিক্ষা-আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে কওমী মহিলা মাদ্রাসার বিস্তার ঘটে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে। দেশের উলামায়ে কেরাম উপলব্ধি করেন— ইসলামি সমাজব্যবস্থা গঠনের জন্য নারীদের ইলমে দ্বীন শেখানো অত্যন্ত জরুরি। সেই উপলব্ধি থেকেই ১৯৮০-এর দশকে শহর ও গ্রাম উভয় এলাকাতেই মহিলা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ঢল নেমে আসে। অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের দান-সদকা, জমি দান, স্থানীয় আলেমদের ত্যাগ— সব মিলিয়ে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে জনতার ভালোবাসা ও ত্যাগের এক জীবন্ত নিদর্শন। এ সকল কওমী মহিলা মাদ্রাসায় কুরআন-হাদীস, আরবি ভাষা, ফিকহ, আকীদা, তাজবীদ, তাফসীর, হিফজ, তাকমীল— এমনকি দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ পাঠক্রম চালু হয়। আজ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য বোনেরা এসব প্রতিষ্ঠানে ইলম ও আমলের আলোক শিখে সমাজের ভিতরে আলোর বীজ ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তাদের মাধ্যমে গড়ে উঠছে— শিক্ষিত মা, নৈতিকতার দিশারী বোন, পরিবার-সমাজের মমতাময় রাহবার এবং নারীদের মধ্যে ইসলামী সংস্কৃতির সন্ধানদাতা একটি আলোকিত প্রজন্ম। কওমী মহিলা মাদ্রাসা শুধু শিক্ষার কেন্দ্র নয়; এটি চরিত্র গঠন, পর্দা-শালীনতা, ইখলাস, তাকওয়া এবং নৈতিকতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও বটে। অসংখ্য প্রতিষ্ঠানে এতিম ও অসহায় মেয়েদের লালনপালন, আবাসিক শিক্ষা, হিফজ বিভাগ, নূরানী-তাজবীদ বিভাগ— সবই পরিচালিত হচ্ছে পরম মমতা ও দায়িত্বশীলতার সাথে। আজ কওমী মহিলা মাদ্রাসা বাংলাদেশের ইসলামী শিক্ষা ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দিগন্ত। হাজারো আলেমা, মুফতিয়া, মুফাসসিরা— শালীনতা, জ্ঞান, তাজকিয়া ও খোদাভীতির অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সেবা দিচ্ছেন। এই প্রতিষ্ঠানগুলো সম্ভ্রম, নৈতিকতা, ঈমান ও ইলমের যে আলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিচ্ছে— তা নিঃসন্দেহে মুসলিম সমাজের জন্য এক বরকতময় আশীর্বাদ।
অতএব, কওমী মহিলা মাদ্রাসার ইতিহাস কেবল ইট-কাঠের প্রতিষ্ঠা নয়; এটি নারীশিক্ষার জাগরণ, দ্বীনের পুনর্জাগরণ, সমাজ সংস্কারের আলোকধারা এবং মুসলিম নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার এক অনন্য গৌরবগাঁথা। |


মতামত